পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী ।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রে ছাউনি ॥
ভেরাণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে ।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে ॥
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন ৷
খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ ॥
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস ।
বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস ॥
আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল ।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বল ॥
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদ-কুড়া মিলে উদর না পুরে ॥
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি ॥
অভাগ্য মনে গুণি অভাগ্য মনে গুণি ।
কত শত খায় জোঁক নাহি খায় ফণী ॥
ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল ।
নদনদী এককার আটদিকে জল ॥
আশ্বিনে অম্বিকা পূজা করে জনে জনে।
ছাগল মহিষ মেষ দিয়া বলি দানে ॥
উত্তম বসনে বেশ করয়ে বনিতা।
অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা ॥
কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ ।
যগজনে করে শীত-নিবারণ বাস ॥
নিযুক্ত করিলা বিধি সভার কাপড় ।
অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড় ॥
মাস মধ্যে মাস্যর আপনে ভগবান ।
হাটে মাঠে গৃহে গোঠে সভাকার ধান ॥
উদয় পুরিয়া অন্ন দৈবে দিলা যদি।
যম-শম শীত তথি নিরমিলা বিধি ॥
পউষে প্রবল শীত সুখী যগজন ৷
তুলি পাড়ি পাছড়ি শীতের নিবারণ ॥
হরিণী বদলে পাইনু পুরাণ খোসলা ।
উড়িতে সকল অঙ্গে বরিষয়ে ধুলা ॥
মাঘে কুঞ্ঝটিকা প্রভু মৃগয়াতে যায় ।
আন্ধারে লুকায় মৃগ দেখিতে না পায় ॥
সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।
পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে ॥
অনল সমান পোড়ে চইতের খরা।
চালু সেরে বান্ধা দিনু মাটিয়া পাথরা ॥
দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান ।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান ॥
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর পিতা হৃদয় মিশ্র এবং মাতা দৈবকী। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে । সম্ভবত ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দরাম পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার জমিদারপুত্রের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। পরে জমিদার রঘুনাথ রায়ের সভাকবিরূপে তাঁরই প্রেরণায় ‘চণ্ডীমঙ্গল' কাব্য রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য এ কবিকর্মের জন্য জমিদার তাঁকে ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুকুন্দরামের পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল অসাধারণ। মঙ্গলকাব্যের প্রথাগত সীমার মধ্যে থেকেও তিনি এতে বাস্তব জীবনচিত্র উপস্থাপনে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাব্যে সাধারণ বাঙালি জীবন, সমকালীন সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা, মানব চরিত্র চিত্রণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা অসামান্য রূপ লাভ করেছে। গণজীবনের করুণ চিত্র বিশ্বস্ততার সাথে অঙ্কনের জন্য তাঁকে দুঃখবাদী কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও তাঁর কাব্য মানবজীবনরসে পূর্ণ। স্বভাবগত কবিত্বশক্তির প্রসাদে তিনি তাঁর কাব্যে নাট্যগুণ ও উপন্যাসের বর্ণনা-নৈপুণ্যের সমন্বয় ঘটান। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ঔপন্যাসিকদের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে ।
রামা - রমণী ।
কুড়্যা - কুঁড়েঘর।
ভেরাণ্ডা - রেড়িগাছ।
খাম - খুঁটি।
পাপিষ্ঠ - জ্যৈষ্ঠ মাসের তীব্র উষ্ণতায় ক্ষুব্ধ ফুল্লরা জ্যৈষ্ঠকে পাপিষ্ঠ বলে অভিহিত করেছে। কেননা এই মাসে খাবার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তার জোটে না।
খরতর - প্রচণ্ড।
কিরণ - আলো ৷
বেঙচের ফল - বেউচ; টক-মিষ্টি জাতীয় বুনো ফল ।
উপবাস - উপোস। না খেয়ে থাকা ।
পুরিল - পূর্ণ হলো ।
মহী - পৃথিবী ।
টুটয়ে - টুটে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়।
পসরা - পণ্য ।
বুলি - বুল থেকে বুলি। বুল অর্থ ঘুরে বেড়ানো। ফুল্লরা মাংসের পসরা নিয়ে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায় ।
খুদ-কুড়া - চালের ক্ষুদ্রতম অংশ; সামান্য খাবার বিশেষ ।
বরিষে - বর্ষিত হয় ।
সিতাসিত - শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষ। সিত ও অসিত; সিত – শুক্ল বা সাদা; অসিত – কৃষ্ণ বা কালো ।
ফণী - সাপ ।
ভাদ্রপদ - ভাদ্র মাস ।
এককার - একাকার।
অম্বিকা পূজা - দুর্গাপূজা।
বসন - পোশাক ।
করয়ে - করে।
বনিতা - নারী বা মেয়ে ।
হিম - শীত বা ঠান্ডা
যগজন - জগৎ-জন বা জগজ্জন; জগৎ-বাসী বা জগদ্বাসী।
সভার - সবার ।
হরিণের ছড় - হরিণের ছাল বা চামড়া ।
মাস্যর - অগ্রহায়ণ মাসের প্রাচীন নাম ।
গোঠ - গোচারণ ভূমি
সভাকার - সবার ।
দৈব - দেবতা; ঈশ্বর; ভগবান ।
যম-শম - মৃত্যু।
তথি - তথায়, সেখানে।
নিরমিলা - নির্মাণ করলে ।
বিধি - বিধাতা ।
পাড়ি - যা পাড়বার জন্য ।
পাছড়ি - দামি বস্ত্ৰ ৷
পুরাণ - পুরনো ৷
খোসলা - এক প্রকার গায়ের কাপড়।
দোপাটা - দুই ফালি কাপড় জোড়া দেওয়া পরিধেয় বস্ত্ৰ ।
কুজ্ঝটিকা - কুয়াশা ৷
মৃগয়া - শিকার ।
মৃগ - হরিণ।
চইত - চৈত্র মাস ।
চালু সেরে বান্ধা দিনু মাটিয়া পাথরা - চালের জন্য বন্ধক দিলাম মাটির পাত্র ।
আমানি - পান্তাভাতের পানি ।
অবধান - শোনা ।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ ‘ফুল্লরার বারোমাস্যা । প্রতিটি মঙ্গলকাব্যকে বেশ কয়েকটি পালায় বিভক্ত করে গীত ও বাদ্য সহযোগে পরিবেশন করা হতো। এক মঙ্গলবারে কাহিনি আরম্ভ করে সমাপ্ত করা হতো আরেক মঙ্গলবারে । এ কারণে কাব্যগুলো হতো দীর্ঘ পরিসরের। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ফুল্লরা ও কালকেতু চরিত্রকে ঘিরে। পশু শিকার ও মাংস বিক্রয়ের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে তারা; অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই বললেই চলে। ‘ফুল্লরার বারমাস্যা'য় মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বারো মাসের পটভূমিতে প্রকৃতির পরিবর্তন এবং ফুল্লরার দুঃখের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করেছেন। ফুল্লরার কণ্ঠস্বরে শোনা যাচ্ছে তার অভাব, দারিদ্র্যময় গার্হস্থ্য জীবনের বর্ণনা। উল্লেখ্য যে, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে ‘বারোমাসী' একটি বিশেষ কাব্যরীতি, যেখানে সংযোজিত হতো জীবনযাপন অথবা নারীর বিরহের বারোমাসভিত্তিক বিবরণ । বারোমাসী রচনায় মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বাস্তবানুগ সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ-শক্তির পরিচয় দিয়েছেন।